”উজ্জ্বল রায়■ সমবেত ব্রাহ্মভক্তগণকে সম্বোধন করিয়া তিনি বলিতেছেন, “নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করা কঠিন। প্রতাপ বলেছিল, মহাশয়, আমাদের জনক রাজার মত। জনক নির্লিপ্ত হয়ে সংসার করেছিলেন, আমরাও তাই করব। আমি বললুম, মনে করলেই কি জনক রাজা হওয়া যায়! জনক রাজা কত তপস্যা করে জ্ঞানলাভ করেছিলেন, হেঁটমু- ঊর্ধ্বপদ হয়ে অনেক বৎসর ঘোরতর তপস্যা করে তবে সংসারে ফিরে গিছলেন।“তবে সংসারীর কি উপায় নাই? -হাঁ অবশ্য আছে। দিন কতক নির্জনে সাধন করতে হয়। তবে ভক্তিলাভ হয়, জ্ঞানলাভ হয়; তারপর গিয়ে সংসার কর, দোষ নাই। যখন নির্জনে সাধন করবে, সংসার থেকে একেবারে তফাতে যাবে। তখন যেন স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, আত্মীয়-কুটুম্ব কেহ কাছে না থাকে। নির্জনে সাধনের সময় ভাববে, আমার কেউ নাই; ঈশ্বরই আমার সর্বস্ব। আর কেঁদে কেঁদে তাঁর কাছে জ্ঞান-ভক্তির জন্য প্রার্থনা করবে। “যদি বল কতদিন সংসার ছেড়ে নির্জনে থাকবো? তা একদিন যদি এইরকম করে থাক, সেও ভাল; তিনদিন থাকলে আরও ভাল; বা বারোদিন, একমাস, তিনমাস, একবৎসর-যে যেমন পারে। জ্ঞান-ভক্তিলাভ করে সংসার করলে আর বেশি ভয় নাই।“হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙলে হাতে আঠা লাগে না। চোর চোর যদি খেল বুড়ি ছুঁয়ে ফেললে আর ভয় নাই। একবার পরশমণিকে ছুঁয়ে সোনা হও, সোনা হবার পর হাজার বৎসর যদি মাটিতে পোঁতা থাক, মাটি থেকে তোলবার সময় সেই সোনাই থাকবে। “মনটি দুধের মতো। সেই মনকে যদি সংসার-জলে রাখ, তাহলে দুধেজলে মিশে যাবে। তাই দুধকে নির্জনে দই পেতে মাখন তুলতে হয়। যখন নির্জনে সাধন করে মনরূপ দুধ থেকে জ্ঞান-ভক্তিরূপ মাখন তোলা হল, তখন সেই মাখন অনায়াসে সংসার-জলে রাখা যায়। সে মাখন কখনও সংসার-জলের সঙ্গে মিশে যাবে না-সংসার-জলের উপর নির্লিপ্ত হয়ে ভাসবে। শ্রীবামাক্ষ্যাপা সাধকশ্রেষ্ঠবামাক্ষ্যাপা বাবার তখন বয়স হয়েছে প্রায় ৭৪ বছর। শরীরের মাংস পি- ঝুলে গিয়েছে। বসে থাকলে উঠতে অসুবিধা হয়। নগেন বাগচি বসিয়ে উঠিয়ে দিতেন। হঠাৎ একদিন ক্ষ্যাপাবাবা রাত্রিতে নগেনকে বললেন “ডাক এসেছে লগেন, ডাক এসেছে”। “ওরা আমাকে ডাকছেন”। নগেন ক্ষ্যাপাবাবাকে বললেন কি সব উল্টো পাল্টা বকছ বাবা। চুপ করো তো! তুমি এখন শুয়ে পড়। এখন গভীর রাত। মায়ের মঙ্গল আরতির এখন অনেক দেরি। এই বলে ক্ষ্যাপা বাবাকে শুয়ে দিলেন এবং পাশের বিছানায় নগেন শুয়ে পড়লেন। নগেনের আর ঘুম আসে না। কেননা নগেন বুঝতে পারলেন ক্ষ্যাপা বাবা আর এ জগতে থাকবেন না। রাত্রি পোহাল। ঊষাকাল হঠাৎ ক্ষ্যাপাবাবা ওই ভোর বেলায় নগেনকে বললেন, “লগেন আমাকে নদীর ঘাটে নিয়ে চল্-আমি চান করব”। নগেন বললেন ক্ষ্যাপাবাবা তোমার শরীর ভাল নাই, এত ভোরে তুমি দ্বারকা নদীর জলে চান করবে!”হ্যাঁ করব শালা ! তাতে তোর কি রে শালা ?” নাদসিদ্ধ ক্ষ্যাপার হুঙ্কারে যেন মহাশ্মশান কেঁপে গেল।