কবি তীর্থ মুরাদনগরের দৌলতপুরে কবি নজরুল-নার্গিসের নামে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার সরকারি প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়াও ওই গ্রামে ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত কবি নজরুল-নার্গিস বিদ্যা নিকেতন সরকারি এমপিওভুক্তি না হওয়ায় শিক্ষা ব্যস্থায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কুমিল্লা গোমতীর এপারে প্রমীলা ওপারে নার্গিস। কবি নজরুল ইসলামের হৃদয়ের দুই সারথী। এ দু’জনকে ঘিরেই কবি নজরুলের প্রেম আর বিরহের অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত কেটেছে কুমিল্লা শহর ও মুরাদনগরের দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লা শহর ও দৌলতপুর থেকে কবির অনেক স্মৃতিচিহ্ন এখন বিলুপ্তির পথে। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা আসেন ৫ বার। কবির বিয়ে থেকে শুরু করে দু’দফায় গ্রেফতার হন এ জেলায়। প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড়ে কবিতা গানের আসর, ঝাউতলায় গ্রেফতার হওয়া, বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, নানুয়া দীঘির পাড়, দারোগা বাড়ি এবং মুরাদনগরের দৌলতপুরসহ কুমিল্লা শহরের অসংখ্য স্থানে কবির স্মৃতিচিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যা সংরক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্তির পথে। অনেক স্থানে নেই কোনো স্মৃতি ফলক। |
১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে কবির প্রথম আগমন ঘটে জেলার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে। এ গ্রামেরই কবির পূর্ব পরিচিত বন্ধু আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে। এ সময় আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস আরা খানমের মাঝে তার মানসীর ছবি খুঁজে পান। দু’জন দু’জনার কাছাকাছি আসেন। এ প্রেম প্রণয়ে পরিণত হয়। কবি নার্গিসকে একই বছরের ১৭ জুন বিয়ে করেন। যা ছিল তার জীবনের প্রথম বিয়ে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কবি বাসর রাতেই দৌলতপুর ছেড়ে কুমিল্লা শহরে চলে আসেন। শহরে কবি ইন্দকুমার সেনের বাসায় অবস্থান করেন। দৌলতপুরে মামার বাড়িতে কবির সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে স্থায়ী না হলেও শহরে কবি ইন্দকুমার সেনের বাসায় অবস্থানকালে তার ভ্রাতৃজয়া গিরিলা দেবীর একমাত্র কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে প্রমীলার (কবির দেয়া নাম) সঙ্গে পরিচয় প্রেম এবং তারপর ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল শুক্রবার কলকাতার ৬নং হাজী লেনে তাদের বিয়ে হয়।
কবি দ্বিতীয়বার কুমিল্লায় আসেন ১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে। এ সময়ে তিনি ব্রিটিশবিরোধী গান গাওয়ার কারণে গ্রেফতার হন। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর শহরের ঝাউতলা থেকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার হন কবি। সর্বশেষ কবি পঞ্চমবারের মতো কুমিল্লায় আসেন ১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই। এ ছিল তার কুমিল্লায় শেষ আসা। কবি নজরুল আর নার্গিসের বিচ্ছেদ হলেও ১৫ বছর অপেক্ষার পর কলকাতা থেকে তার তালাকনামা এনে নার্গিস পরে কবি আজিজুল হাকিমের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন।
কবির অনেক স্মৃতি চিহ্ন বেদখল ও বিলুপ্তির পথে
১৯৮৩ সালে কবির স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহে তৎকালীন জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী জেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো হয়। এসব ফলকে কবির গান, কবিতা, ছড়া ও বাণী তুলে ধরা হয়। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে কুমিল্লায় নজরুল স্মৃতিগুলো বেদখল হয়ে গিয়েছে। ১৯৬২ কুমিল্লার তৎকালীন জেলা প্রশাসক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কুমিল্লার কান্দিরপাড়-ধর্মপুর রেলস্টেশন সড়কের নজরুল এভিনিউ নামকরণ করেন।
দক্ষিণ চর্থায় বর্তমান সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের পাশে কুমার শচীন দেব বর্মনের যে বাড়িতে বসে কবি সঙ্গীত চর্চা করতেন সেখানে ১৯৮৩ সালের ২৯ আগস্ট নজরুল স্মৃতি রক্ষা পরিষদ একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করার পরও কবি কিংবা শচীন কর্তার স্মৃতি রক্ষায় দীর্ঘ দিন সেই বাড়িটি পরিত্যক্ত ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের উদ্যোগে তা সংস্কার করা হয়।
কুমিল্লা কোম্পানিগঞ্জ-নবীনগর সড়ক ধরে ৮ কিলোমিটার সামনে আসলেই কবিতীর্থ দৌলতপুর গ্রাম। এ গ্রামে ঢুকতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়বে ‘নজরুল তোরণ’। তোরণের দুই পাশে ইট-সিমেন্টের তৈরি কালো রঙের টুকরো টুকরো ব্লকে সাদা কালিতে লেখা কবির পংতিমালা। অযত্ন-অবহেলায় অনেক ব্লক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। ওই পথ ধরে আধা কিলোমিটার ভিতরে গেলেই খাঁন বাড়ি। এখানে রয়েছে আলী আকবর খানের সুনিপুণ কারুকাজে শোভিত দ্বি-তল বাড়ি। এ বাড়িতেই থাকতেন কবি নজরুল।
দীর্ঘদিন ধরে কোন প্রকার সংস্কার না করায় বাড়িটির পলেস্তার খসে পড়ছে। এ ভবনের পেছনে বাঁশঝাড় পার হলেই কবির বাসর ঘর। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কবির বাসরঘরটি আটচালা ছিল। পরে চৌচালা করা হলেও আয়তন ও ভিটির কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। ওই ঘরেই ছিল নার্গিসের ব্যবহার করা কাঠের সিন্দুক। অযত্ন ও অবহেলার কারণে সিন্দুকটি কোথায় আছে তা কেউ বলতে পারে না। এক সময় ওই ঘরে বাসর খাটটিও ছিল। সেটি পাশের একটি আধাপাকা ঘরে রাখা হয়েছে।
কবিপত্নী নার্গিস বংশের উত্তরসূরী বাবলু আলী খান জানান, এ বাড়ির পুকুর ঘাটের আম গাছ তলায় কবি দুপুরে শীতল পাটিতে বসে গান ও কবিতা লিখতেন। খান বাড়ির ছেলে-মেয়েদের নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখাতেন। পুকুরের পানিতে সাঁতার কাটতেন। শখ করে পুকুরে জাল আর পলো দিয়ে মাছ শিকার করতেন। কবির ওই স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য দৌলতপুরে বানানো হয়েছে ‘নজরুল মঞ্চ’।
তবে আশার কথা হচ্ছে মহানগরীর ধর্মসাগর উত্তর পাড়ে বিগত ২০১৩ সালের ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। ২০১৫ সালে কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উদযাপনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমন এ উপলক্ষে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. হাসানুজ্জামান কল্লোলের উদ্যোগ ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের তত্বাবধানে কবি নজরুলের অবহেলিত ওইসব স্মৃতিচিহ্নগুলো সংস্কার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়। স্মৃতিচিহ্নের মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসংলগ্ন রাণীর দীঘির পাড়ের পশ্চিম-দক্ষিণ কর্নারে যেখানে বসে কবি গান ও কবিতা চর্চা করতেন সেই স্থানটি সংরক্ষণ করে চারপাশে দেয়াল নির্মাণ করা হয় এবং কবি’র প্রতিকৃতি ফলক নির্মাণ করা হয়। কিন্তু কবির স্মৃতি বিজরিত অনেক নিদর্শন এখনো সংরক্ষণের অভাবে বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
কুমিল্লায় ৩ দিনের নানা কর্মসূচি |
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় ও কুমিল্লা জেলা প্রশাসন কর্তৃক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির প্রথম দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. আবুল ফজল মীরের নেতৃত্বে প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ, নজরুল ইন্সটিটিউট কেন্দ্র-কুমিল্লা ও নজরুল পরিষদসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ‘চেতনায় নজরুল’ ম্যুরালে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে জাতীয় কবি নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে নজরুলের জীবনভিত্তিক আলোকচিত্র ও পুস্তক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হবে। এরপর ‘জাতীয় জাগরণে কবি নজরুল’ প্রতিপাদ্য বিষয়ে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ করা হবে।
এছাড়া শুক্রবার সকাল ১০টায় জেলার মুরাদনগরের কবিতীর্থ দৌলতপুরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতা এবং শনিবার একই স্থানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন আলোচনা সভা, কবিতা আর নজরুল সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে কবি নজরুল স্মরণে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।